Tuesday, March 1, 2016

ফ্রিল্যান্স জীবনে আমার পদার্পণ

ফ্রিলান্সিং এ আমার আসা হঠাৎ করেই। তার আগ পর্যন্ত আমি একটি এনজিও তে কাজ করতাম - জাগো ফাউন্ডেশন। ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১.৫ বছর আমি এখানে চাকরি করি। জাগো ফাউন্ডেশনে আমি ছিলাম PR & Publications Department এর এসিস্টেন্ট ম্যানেজার। চাকরিটা আমার খুবই পছন্দ ছিল, কিন্তু আমার বাসা থেকে প্রতিদিন অফিস যেতে আসতে ৩ ঘন্টার মতো লাগত। প্রতিদিনের যাওয়া-আসাতে আমি মোটামুটি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তাছাড়া কাজের অনেক প্রেশারও থাকতো সবসময়। ২০১২ সালের শেষে আমি তাই চাকরিটা ছেড়ে দেই কিছুদিনের জন্য। ভেবেছিলাম পরে আবার চাকরিতে ফিরে যাব। আমার মেয়ের জন্ম ওই বছরেই।

মেয়ের জন্মের সময় কিছুদিন আমি বাড়িতেই বিশ্রাম নেই, পরে এক বন্ধু'র কাছে শুনি oDesk (বর্তমানে Upwork) এর কথা। ২০১৩ সালের নভেম্বরে একটি একাউন্ট করি Upworkএ। প্রথমেই উপার্জনের কথা চিন্তা না করে আমি মনোযোগ দেই আমার একাউন্টটি সাজাতে। ইন্টারনেট খুঁজে বোঝার চেষ্টা করি ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে কেমন কাজ গ্রহণযোগ্য। বেশ কিছু ভালো ওয়েবসাইটের আর্টিকেলগুলো পড়ি, আর তারপর নিজের মতো কিছু স্যাম্পল তৈরি করি। নিজের একাউন্টটা পুরোপুরি শেষ করে তারপর কাজে এপ্লাই করা শুরু করি।


আমার ভাগ্যটা ভালো ছিল, তাই প্রথম এপ্লিকেশন করার ৭ দিনের মাথায় একটি ছোট ট্রান্সক্রিপ্সনের-এর কাজ পাই, মাত্র ৫ ডলার এর। এই ছোট কাজটি করতেই আমার সারাদিন লেগে যায়, কিন্তু আমার ভাগ্য আসলেই ভালো ছিল। ক্লায়েন্ট আমার কাজে খুশি হয় আর আমাকে ভালো একটা ফিডব্যাক দেয়। শুধু তাই না, সেই ক্লায়েন্ট আমাকে আরও কিছু ছোট কাজ দেয়, আমাকে হাতে কলমে কাজ শিখিয়ে দেয়, কিছু ভালো সফটওয়ারের নাম আমাকে দেয়। তারপর ধীরে ধীরে আমি আমার প্রোফাইলটা সুন্দর করে সাজাতে থাকি; আস্তে আস্তে, খুব কম টাকায় প্রথম কাজগুলো করি। আমার টার্গেট ছিল আগে আমার একাউন্টটি সাজানো, তারপর টাকার চিন্তা করা। কারন আমি জানতাম, আমার প্রোফাইল সুন্দর না হলে কাজ পাওয়া কঠিন হবে।

আমার প্রথম মাসের আয় ছিল ২৩,০০০/- টাকা, এবং তার পরের মাসে ১৫,০০০/- টাকা। প্রথমদিকে আমি অনেক কষ্ট করতে হতো, রাত জেগে ৫/৬ ডলারের কাজ করতাম। খুব অল্প টাকার কাজের জন্য সারা রাত জেগে কাজ করছি। ভুল হয়েছে কাজে কিছু কিছু, সেগুলো বার বার করে দিয়েছি কোন টাকা না নিয়ে। কিছু ক্লায়েন্ট কে মাঝে মাঝে এক্সট্রা কাজ করে দিতে হয়েছে, শুধুমাত্র ভালো ফিডব্যাকের জন্য। ২/১ বার কাজ পছন্দ হয়নি বলে ক্লায়েন্ট টাকা দেয়নি, তাও মেনে নিয়েছি। তাদের সাথে ভালো ব্যাবহার করেছি যখন বুঝেছি আমি নতুন দেখে আমার সাথে চালাকি করছে। মোট কথা, প্রথম ৩/৪ মাস মোটামুটি কিছু টাকা আয় করতে আমার অনেক কষ্ট করতে হয়েছিলো। তবে আমার ভাগ্য যে কিছু ভালো ক্লায়েন্টের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো; তারা আমাকে কষ্ট করে কাজ শিখিয়েছিল। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

পরে ধীরে ধীরে আমি ট্রান্সক্রিপ্সনের কাজ ছেড়ে দেই, আর লেখালেখির কাজ শুরু করি। প্রথমে কিছু ৫০০ শব্দের আর্টিকেল লিখে দেই এক ইউক্রেনিয়ান ক্লায়েন্টের জন্য, প্রতিটা আর্টিকেল ২$ করে, পরে আসতে আসতে নিজের কাজের রেট বাড়াতে থাকি। একি ক্লায়েন্ট পরে আমাকে একটা ছোট ই-বুক লেখার কাজ দেয়, ৩৫০০ শব্দের, মাত্র ২০$ এর কাজ। অবশ্যও কাজটা তার পছন্দ হয় এবং সে আমাকে ১০$ এর একটা ছোট বোনাস দেয়, সেটা আমার ফ্রিলেন্সিং ক্যারিয়ারে প্রথম বোনাস ছিল।

প্রথম থেকেই আমার কাজ পেতে বেশি কষ্ট হয়নি, কিন্তু কষ্ট হয়েছে আমার কাজের জন্য ভালো রেট পেতে। একজন নেটিভ ইংলিশ রাইটার যে রেটটা পাবে, সেটা আমাকে দিতে ক্লায়েন্টরা চাইত না, কারন আমার ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ ইংলিশ না। খুব ধীরে ধীরে আমি চেষ্টা করতে থাকি আমার কাজের রেট বাড়াতে। শুরু করেছিলাম ৩$/ঘণ্টা রেটে, এখন সেটা বেড়ে হয়েছে ৮$/ঘণ্টা। আমি মূলত এখন ২৫০০, ৩৫০০, ৫০০০, ৭৫০০, ১০০০০, ১২৫০০ ও ১৫০০০ শব্দের ই-বুক লিখি, এবং প্রতি ১০০ শব্দের জন্য ১.৫ ডলার করে পাই।

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি বেসিস (BASIS) থেকে 'ফিমেল ক্যাটাগরি'তে আউটসরসিং এ্যাওয়ার্ডটি পাই। এটা আমার জীবনের অন্যতম একটি ঘটনা ছিল। এই এ্যাওয়ার্ডটি আমার সামনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা। তাছাড়া, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে আমি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল একাডেমী, বিলেন্সার ও ট্রান্সপে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরেকটি এ্যাওয়ার্ড পাই, এটিও ফিমেল ক্যাটাগরিতে ও আউটসরসিং এ আমার অবদানের জন্য।

আমি এখন দিনে ৩/৪ ঘণ্টার মতো কাজ করে থাকি, এবং বাকি সময়টা আমার পরিবারকে দেই। তাছাড়া UpWork-এ আমার একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যার নাম Writers-on-the-Block. এটা একদম শুরুর দিকে। আমার পরিকল্পনা আগামি ২ বছরের মধে কমপক্ষে ১০জন লেখককে একসাথে করে কাজ করা, তাদের কাজ দেয়া। এখন আমার প্রতিষ্ঠানে মাত্র ২ জন আরও কাজ করছে। আমি আরওঁ লেখক খুজছি। আমার মতো আরও অনেকে, যারা কোন কারনে চাকরি ছেড়েছেন, বা ছাড়তে হয়েছে, বা যাদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কোন কারনে চাকরি করতে পারছেন না, তাদের প্রতি মাসে কিছু হলেও আয় করার উপায় করে দেয়া।

ফ্রিলান্সিং কোন সহজ ব্যাপার নয়। এখানে লাগবে অনেক, অনেক, অনেক সহনশীলতা এবং সময়। মনে রাখবেন, এটি একটি আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেস, এখানে আপনার প্রতিযোগী সারা বিশ্ব। নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে যাতে আপনি পুরো পৃথিবীর সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে পারেন। আগে ভালো করে কাজ শিখতে হবে, যে কাজটা ভালো লাগে বা ভালো পারেন সেটাই করা ভালো।

এই আর্টিকেলটি The Prominent নিউজ পোর্টালে ছাপা হয়েছিলো।
লিঙ্কঃ http://www.the-prominent.com/career-freelancers-article-6007/

Read this in English here

No comments:

Post a Comment