Monday, April 11, 2016

ফ্রিল্যান্স জীবনের ভুল ধারনাগুলো - ১

ফ্রিল্যান্স কর্মীরা অন্যদের কাছ থেকে যেসব কথাগুলো সবচেয়ে বেশি শুনে সেগুলো হলোঃ

"বাসায় বসে কাজ কর ... এটা কি কিছু হলো?"

"রাত জেগে জেগে কাজ করতে হয়!"

"এই কাজের কোন গ্যারান্টি আছে নাকি ... আজকে আছে, কালকে নাই!"

"আরে এইটা কোন কাজ হলো ... এই কাজ তো সবাই পারে।"

উপরের সবগুলোই যে মোটামুটি ভ্রান্ত ধারণা, সেটা নিয়েই আজকের আমার ব্লগ।

ভুল ধারণা#১
"বাসায় বসে কাজ কর" - এটা আসলে একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। আমরা যারা ফ্রিল্যান্স কর্মী তারা বাসায় বসে কাজ করি, না ছাদে বসে কাজ করি, বা কোন কফি শপে বসে কাজ করি, এটা'র সাথে আমাদের কাজের কোন সম্পর্ক নেই। আমি বাংলাদেশে বসে আছি, আর আমার ক্লায়েন্টরা ইউ.এস. বা ইউরোপের কোন দেশে বসে আছে। আমরা একা তার কাজ করছি তাই আমার প্রয়োজন পরছে না এই কাজের জন্য একটি অফিস খুলে বসতে। আমি তাই আমার বাসায় বসে, আমার ওয়ার্কস্টেশনে বসে কাজ করতে পারছি। হ্যাঁ, যদি আমার সাথে আরও ১০জন বসে কাজ করতো, তাহলে আমার হয়তো একটা ছোট অফিস খুলতে হতো। তার প্রয়োজন নেই বলেই আমি আমার ঘরে থেকেই কাজ করতে পারছি, সেটা আমার জন্য একটা বাড়তি সুবিধা।

এমন অনেক বড় বড় ফ্রিল্যান্স কর্মী আছেন যারা নিজেদের অফিস নিয়ে, নিজেদের বড় একটা দল নিয়ে কাজ করছেন; আবার আমার মত কিছু নতুন ফ্রিল্যান্সার নিজেদের বাসায় একটা ছোট অফিসের মত তৈরি করে কাজ করছি। যারা আরও নতুন, তারা হয়তো এখনও নিজেদের বেডরুমে বিছানায় বসে কাজ করে যাচ্ছে ... তাই বলছি, কে কোথায় বসে কাজ করে,তা একান্ত তাদের নিজের এবং আপেক্ষিক একটি ব্যাপার।

ভুল ধারণা#২
"রাত জেগে কাজ করা" ব্যাপারটাও আপেক্ষিক।

প্রথমে মনে রাখতে হবে যে, আমাদের ক্লায়েন্টের প্রায় সবাই ইউএস, ইউকে, কানাডা বা কোন ইউরোপিয়ান দেশের বাসিন্দা। যখন আমাদের রাত, তাদের দিন। যদি আমরা তাদের কাজগুলো পেতে চাই, আমাদের প্রয়োজনেই আমাদেরকে রাত জাগতে হবে তাদের সাথে কথা বলার জন্য; তারা কষ্ট করে আমাদের জন্য রাত জাগবে না। তাছাড়া, রাতের বেলা বেশি বেশি করে কাজ পোস্ট হয়। নতুন ফ্রিল্যান্স কর্মীরা তাই রাত জেগে কাজে আবেদন করতে থাকে। একটু নামডাক হলে, বা ভালো একটা বাঁধা ক্লায়েন্ট পেলে আর কেউ পরে রাত জাগে না।

আরেকটা বড় কারন আছে এই "রাত জেগে কাজ করা"র পেছনে। অনেক ছাত্রছাত্রীরা আজকাল তাদের অবসর সময়ে এমন টুকটাক ফ্রিল্যান্স কাজ করছে। তারা দিনের বেলায় ক্লাস আর পড়াশোনা করছে, আর রাতে কাজ করে হাতখরচের টাকাটা জোগাড় করছে। আমি এমন কিছু চাকরিজীবীর কথাও জানি যারা রাতে কয়েক ঘণ্টা ফ্রিল্যান্স কাজ করে কিছু এক্সট্রা ইনকামের জন্য। তাদের জন্য আসলেই রাত জেগে কাজ করাটাই স্বাভাবিক।

ভুল ধারণা#৩
৩নং কথাটা একসময় প্রাইভেট চাকরীর ক্ষেত্রেও মানুষ বলত, যা এখন আর কেউ বলে না। আগে প্রাইভেট চাকরীর কোন গ্যারান্টি ছিলো না, মানুষ সরকারী চাকরি পছন্দ করতো। ফ্রিল্যান্স কাজের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই।

আমরা যারা একটা মার্কেটপ্লেসে প্রোফাইল করে কাজ করি, তাদের জন্য আসলে একটু গ্যারান্টি কমই থাকে। কোন কারনে যদি আমাদের প্রোফাইলে কিছু হয়, আমরা অনেকটা পিছিয়ে যাবো। হয়তো আরেকটা প্রোফাইল বানাতে হবে, আবার নতুন করে কাজ শুরু করতে হবে। কিন্তু যারা সরাসরি কোন ক্লায়েন্টের সাথে কাজ করছে, তাদের জন্য রিস্ক কম। এমনও ফ্রিল্যান্স কর্মী আছে যারা বছরের পর বছর একজন ক্লায়েন্টের সাথেই কাজ করে যাচ্ছে; তাদের জন্য এটা একটা সাধারণ চাকরীর মতই। পার্থক্য একটাই, ক্লায়েন্ট আর কর্মী দু'জন দু'দেশে বসে আছে।

আরেকটা কথা মনে রাখবেন, কেউ যদি আসলেই কাজ পারে, তাকে আটকানো কঠিন। যেকোন চাকরীতে, যেকোনো প্রতিষ্ঠানে, যে কোন ভাবেই হোক, সে কাজ করতে পারবে - সেটা একটা সাধারণ চাকরীই হোক, আর ফ্রিল্যান্স হোক।

ভুল ধারণা#৪
আমি বলছি না যে সবাই ফ্রিল্যান্স কাজ করতে পারবে না। আমি বলতে চাচ্ছি যে ব্যাপারটা এত সহজও না। যারা ফ্রিল্যান্স কাজ করছে তারা সবাই কষ্ট করে কাজ শিখে, অনেক চেষ্টা করে আস্তে আস্তে একটা ভালো পর্যায়ে আসতে পেরেছে। এমন নয় যে কাজগুলো অনেক সহজ কিছু, একবার শুরু করলেই অনেক সফল হওয়া যায়। উল্টো আমি বলবো, যে একজন ফ্রিল্যান্স কর্মী'র কাজ অনেক বেশি কঠিন; এখানে সফল হওয়া অনেক বেশি কষ্টের।

বাংলাদেশে মোটামুটি সবার জীবনের একটাই লক্ষ্য থাকে - একটা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো সাবজেক্টে ভর্তি হওয়া, একটা ভালো সিজিপিএ নিয়ে বের হওয়া। তারপর একটা ভালো চাকরী খোঁজা। এর কারনে দেখা যায়, ইংলিশে অনার্স করে আর কম্পিউটার সায়েন্সে অনার্স করা দু'জন একই অফিসে বসে কাজ করছে। ইন্টার্ভিউতে সবার কাছেই প্রায় একইরকম কিছু প্রশ্ন করা হয়, যার উত্তর সবার জানা, এবং সবাই কাছাকাছি উত্তর দেয়। দেখা যায়, আমি যা পড়েছি বা আমি যা পারি - তার সাথে আমার কাজের কোন সম্পর্ক নেই। সমাজবিজ্ঞান বা ইংলিশ লিটারেচার পড়ে কেউ ব্যাঙ্কে চাকরী করছে, আবার বাংলা সাহিত্য পরে বিসিএস দিয়ে পুলিশের চাকরীতে চলে যাচ্ছে কেউ কেউ। মানে, আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমরা যা পারি বা যে বিষয়ে আমাদের জ্ঞান আছে, অনেক সময়ে চাকরীর ক্ষেত্রে সেগুলো কাজে লাগে না।

আর আমরা যারা ফ্রিল্যান্স কাজ করি তাদের কাজটা পুরোপুরি তাদের নিজেদের স্কিল, বা দক্ষতার উপর নির্ভর করে। আমি যে কাজটা পারি বা যে কাজটা আমি শিখে এসেছি, শুধু সেই কাজটাই আমি করতে পারবো। কাজটা আমাকে খুব ভালোভাবে জানতে হবে; কাজটাতে আমাকে দক্ষ হতে হবে - সে যেই কাজই হোক না কেন! কাজেই বুঝতে পারছেন - ফ্রিল্যান্স কাজ করতে হলে আপনাকে কাজ জানতে হবে, এবং সেটা একটা ডিগ্রি জোগাড় করার মতই, বা তার চেয়েও, বেশি কঠিন। হ্যাঁ, কাজ জানলে আপনি অবশ্যই কাজ করতে পারবেন, কিন্তু না জানলে - আপনার যতই ডিগ্রি থাকুক - আপনি পারবেন না। তাহলে কি ফ্রিল্যান্স কাজ করা খুব সোজা? আপনি নিজেই আপনার এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন!

এই বিষয় নিয়ে আলাপের শেষ নেই, তাই পরে আরেকদিন বাকিটা শেষ করবো। ধন্যবাদ!

এই আর্টিকেলটি The Prominent নিউজ পোর্টালে ছাপা হয়েছিলো।
লিঙ্কঃ http://www.the-prominent.com/career-freelancers-article-6011/

No comments:

Post a Comment