আমরা যারা ফ্রিল্যন্সার তাদের কাজের কোন নির্দিষ্ট সময় থাকে না; আমরা যেমন রাত ১২টার পর কাজ শুরু করতে পারি, তেমন আবার ভোর ৫টায় উঠে কাজ করতে পারি। বেশির ভাগ সময় আমাদের কোন অফিস থাকে নি, তাই আমাদের সকালে ঘুম থেকে উঠে ফর্মাল কাপড় পরে কাজে যেতে হয় না। আমরা বাসায় যা পরে থাকি তাই নিয়ে, সকালে উঠে এক কাপ কফি হাতে নিয়ে ল্যাপটপের সামনে বসে যেতে পারি। হ্যাঁ, আমাদের এই পেশাটা একটু আরামের, কিছু কিছু দিক দিয়ে অনাড়ম্বর ও ঘরোয়া, কিন্তু তার মানে এই নয় যে ফ্রিল্যান্সিং-এ কোন প্রফেশনালিস্ম বা পেশাদারীত্ব থাকবে না। ফ্রিল্যান্সিং একটা পেশা, তাই এখানে কিছুটা পেশাদারীত্ব অবশ্যই থাকতে হবে।
ফ্রিল্যান্সিং-এ "পেশাদারীত্ব" থাকা মানে আপনার কোন ক্লাএন্টকে "স্যার" বলে ডাকা নয়, বা বইয়ের ভাষায় কথা বলা নয়। আপনি স্বাভাবিক থেকেও, বন্ধুসুলভ থেকেও একজন "পেশাদার" হতে পারেন। জেনে নিন, একজন আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্ট আপনার কাছে কেমন ব্যবহার আশা করেন।
"আমি ফ্রিলেন্সিং করতে চাই।"
"আমি কি ফ্রিলেন্সার হতে পারবো?"
"আমি ফ্রিলেন্সিং শিখতে চাই।"
এই প্রশ্নগুলো প্রায়ই শুনি, কিন্তু উত্তরগুলো হয় ভিন্ন। আমাকে বলতে হয়, "ভাইয়া/আপু, আপনার প্রশ্নটাই আসলে ঠিক নয়। ফ্রিলেন্সিং শিখবো বা ফ্রিলেন্সিং করবো বলে আসলে কিছু নেই!"
তাহলে? ব্যাপারটা আসলে কি - ফ্রিলেন্সিং কোন স্পেশাল কাজ না যেটা আপনি শিখতে পারবেন, অথবা যেটা কম্পিউটারের সামনে বসে আপনি করতে পারবেন। আপনি যেই কাজটা পারেন, বা করতে চান, সেটাই আপনি একজন ফ্রিলেন্সার হিসেবে করতে পারেন।
আপনি কি হতে পারবেন একজন সফল মুক্তপেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্স কর্মী? এই পেশায় যা যা প্রয়োজন সেই গুনগুলো কি আপনার আছে? আসুন, দেখা যাক!
প্রথমেই আমরা এই পেশাটাকে একটা সাধারণ চাকরীর সাথে তুলনা করি। একটা চিরাচরিত চাকরীর বাজারে প্রবেশ করতে হলে আমাদের প্রথমেই যা দরকার তা হল একটা ডিগ্রি - অনার্স বা মাস্টার্স, বা তারচেয়েও বেশি কিছু একটা। আপনার সিভি-তে ২/১টা ডিগ্রি বা সার্টিফিকেট না থাকলে আপনি কোন ইন্টার্ভিউতে ডাক পাবেন না, চাকরী তো দুরের কথা। আপনি যেই কোম্পানিতে চাকরী করতে চান তারা সবার আগে আপনার সিভি-তে আপনার ডিগ্রি দেখবে, আপনার সিজিপিএ দেখবে, আপনি কোন জায়গা থেকে পড়াশোনা করে এসেছেন তা দেখবে।
ফ্রিল্যান্স জগতে ডিগ্রি গুরুত্বপূর্ণ নয়, অন্ততঃ খুব একটা নয়। ইউরোপের কোন একটা দেশে বসা একজন ক্লায়েন্টের কাছে এটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যে আপনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়েছেন, না প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আপনার সিজিপিএ ৩.৯৯ হলেও তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, আবার ২.৯৯ হলেও নয়। (হ্যাঁ, কিছু কাজের ক্ষেত্রে হতে পারে। আপনার ক্লায়েন্ট যদি আপনাকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিসের কাজে সাহায্য করতে বলে, সে চাইবে যেন আপনি একজন ভালো ছাত্র হন)। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা হয়তো আপনার পড়াশোনার বিষয় বা আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে চাইবে, কিন্তু সেটাও খুব বিরল। আপনার সিজিপিএ কিংবা আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম তারা জানতে চাইবে না। অন্ততঃ আমার সাথে সেটা কখনও হয়নি।
স্বাগতম আপনাকে একজন ফ্রিল্যান্স কর্মী'র জগতে; আশা করছি এই ভিন্নধর্মী এবং বিকল্প পেশাটি আপনার জন্য একটি ঠিক সিদ্ধান্ত হবে!
কিন্তু কেন আমি "ফ্রিল্যান্সিং"কে একটি বিকল্প পেশা বলছি? এটি মোটেও একটি নতুন কোন চিন্তাধারা নয় যেটা আমরা - আমাদের এই নতুন প্রজন্ম - আবিস্কার করেছি। অনেক অনেক বছর ধরেই মানুষ মুক্তপেশাজীবী বা "ফ্রিল্যান্স কর্মী" হিসেবে কাজ করে আসছে। এই ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়, যেটা হটাৎ করেই একটা ঝোঁক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম হটাৎ করেই "ফ্রিল্যান্সিং" নিয়ে মাতামাতি শুরু করেছে, এবং তার পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে বলে আমি মনে করি। আমাদের দেশে যে পরিমাণ মেধা ও দক্ষতা রয়েছে, তার তুলনায় আমাদের চাকরীর বাজার খুবই ছোট। যা চাকরী আছে তা দিয়ে খুব কম পরিমাণের লোকের কর্মসংস্থান হবে, এবং তার প্রমান আমাদের ভয়াবহ বেকার সমস্যা। আমাদের যে পরিমাণ অফিস আর সংস্থা আছে, তাতে হাজার হাজার শিক্ষক, ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরি হতে পারে, কিন্তু তাদের কি হবে যারা একটু ভিন্নধর্মী কাজ পছন্দ করে? একটু অ-প্রথাসিদ্ধ সেক্টরে আমাদের যে লোকবল আছে, তাদের জন্য একটা ভালো কাজ খুজে পাওয়া - যেখানে ভালো বেতন পাওয়া যাবে - খুবই কঠিন একটা ব্যাপার। বাংলাদেশে কত আর ওয়েবসাইট তৈরি হয়, কয়টা বই লেখা হয়, কয়টা মোবাইল অ্যাপ বানানো হয় প্রতিবছর?
ফ্রিলান্সিং এ আমার আসা হঠাৎ করেই। তার আগ পর্যন্ত আমি একটি এনজিও তে কাজ করতাম - জাগো ফাউন্ডেশন। ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১.৫ বছর আমি এখানে চাকরি করি। জাগো ফাউন্ডেশনে আমি ছিলাম PR & Publications Department এর এসিস্টেন্ট ম্যানেজার। চাকরিটা আমার খুবই পছন্দ ছিল, কিন্তু আমার বাসা থেকে প্রতিদিন অফিস যেতে আসতে ৩ ঘন্টার মতো লাগত। প্রতিদিনের যাওয়া-আসাতে আমি মোটামুটি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তাছাড়া কাজের অনেক প্রেশারও থাকতো সবসময়। ২০১২ সালের শেষে আমি তাই চাকরিটা ছেড়ে দেই কিছুদিনের জন্য। ভেবেছিলাম পরে আবার চাকরিতে ফিরে যাব। আমার মেয়ের জন্ম ওই বছরেই।
মেয়ের জন্মের সময় কিছুদিন আমি বাড়িতেই বিশ্রাম নেই, পরে এক বন্ধু'র কাছে শুনি oDesk (বর্তমানে Upwork) এর কথা। ২০১৩ সালের নভেম্বরে একটি একাউন্ট করি Upworkএ। প্রথমেই উপার্জনের কথা চিন্তা না করে আমি মনোযোগ দেই আমার একাউন্টটি সাজাতে। ইন্টারনেট খুঁজে বোঝার চেষ্টা করি ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে কেমন কাজ গ্রহণযোগ্য। বেশ কিছু ভালো ওয়েবসাইটের আর্টিকেলগুলো পড়ি, আর তারপর নিজের মতো কিছু স্যাম্পল তৈরি করি। নিজের একাউন্টটা পুরোপুরি শেষ করে তারপর কাজে এপ্লাই করা শুরু করি।